বাঁশের কঞ্চির ছিপের মাথায় হাত দুয়েক করে লম্বা শক্ত নাইলনের সুতা। এর শেষ
প্রান্তে শক্তপোক্ত মাঝারি আকৃতির বড়শি। সেই বড়শিতে ছোট ছোট টাকি মাছের
পেটে গেঁথে সন্ধ্যায় হাওরপারের মাটিতে ছিপের গোড়া গেড়ে বড়শি পাতলেন এক
কৃষক। রাতের বেলায় টোপ গিলে বড়শিতে আটকে থাকে শোল-গজার-বোয়ালসহ অনেক মাছ।
বড়শির
টোপ যদি হয় চেলা-পুঁটি, আর যদি পাতা থাকে ভোরে বা দিনে, তবে অনেক সময়
কপালে মাছরাঙা পাখিও জোটে। জুটতে পারে পানকৌড়িসহ জলজ বা জলঘেঁষা মাছখেকো
পাখি। যেমন ডাহুক, বক, ডুবুরি, শঙ্খচিল।
তো, হাওরপারের ওই কৃষক ভদ্রলোক
এক ভোরে পেলেন একটি নতুন শিকার—অচেনা পাখি। খুশিতে হাত বাড়াতেই সহজেই ধরতে
পারলেন ওটি। বড়শি বিঁধেছে ঠোঁটের গোড়ার দিকে। বড়শির সুচালো আগাটা ঠোঁটের
তলা দিয়ে বেরিয়ে আছে। রক্তাক্ত ঠোঁট-চোখ-গাল ও কপাল। একেবারে কাহিল বেচারা।
জীবন যায় যায়। দুই ঠোঁট ফাঁক করে আছে। জিব বেয়ে ফোঁটায় ফোঁটায় রক্ত গড়ছে।
খুশি
মনেই পাখি ও মাছ নিয়ে যখন বাড়ি ফিরছেন ওই কৃষক, পথে এক ভদ্রলোক দরদাম করে
১৩০ টাকায় পাখিটিকে কিনে উড়িয়ে দিলেন আকাশে। পাখিটি কেনার আগেই সেই
ভদ্রলোক আমাকে ফোন করেছিলেন। বর্ণনা দিয়েছিলেন পাখিটির। আমি ওনাকে
মুঠোফোনে ক্যামেরায় ছবি তুলতে বলেছিলাম। পাখিটি ছেড়ে দেওয়ার পরও কথা হলো
আমাদের। তিনি আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু। গত আগস্টের প্রথম সপ্তাহে সুনামগঞ্জের এক
আত্মীয়ের বাড়ি বেড়াতে গিয়েছিলেন তিনি। ঘটনাটি সেখানকারই।
কিন্তু ঢাকায়
ফেরার পর ছবির মান দেখে দেখে হতাশ হলাম। অনেক কষ্টে পাখিটিকে শনাক্ত করতে
পারলাম। এটি অপ্রাপ্তবয়স্ক বাঘা বক। প্রাপ্তবয়স্ক ও অপ্রাপ্তবয়স্ক বন্দী এ
রকম পাখি আমি সাকল্যে চারবার দেখেছি। চারবারই শ্রীমঙ্গলে। এর ভেতর একটি
অপ্রাপ্তবয়স্ক পাখি বড়শিতে আটকা পড়েছিল।
দুর্লভ আবাসিক শ্রেণির এই পাখি
চরম বিপন্ন প্রজাতি হিসেবে বিবেচিত। স্বভাবে লাজুক, নিশাচর ও আত্মগোপনে
অবিশ্বাস্য রকম পারদর্শী। বিপদ বুঝলে ঘাড়-গলা টান টান করে আকাশমুখী হয়ে
স্থির দাঁড়িয়ে থাকবে। ধরা পড়লে বা বিপদ বুঝলে মাথার ঝুঁটির চমৎকার পালকগুলো
খাড়া করে দিয়ে ঠোঁট ফাঁক করে ভয় দেখাবে; চোখে জ্বলবে রাগ ও আক্রোশ।
বয়সী
পাখির চেয়ে অপ্রাপ্তবয়স্ক পাখি দেখতে সুন্দর। ঘাড় খাটো হওয়ায় মুখোমুখি
দেখলে এদের হঠাৎ ঝুঁটি তোলা বাহারি কবুতর মনে হতে পারে। অপ্রাপ্ত বয়স্কদের
শরীরের রং একনজরে ধূসর-লালচে ও ছাই-বাদামি। ঘাড় ও মাথার ঝুঁটির পালকগুলোতে
চমৎকার সাদা রঙের কারুকাজ। ঝুঁটি ফোলালে পালকের মাথাগুলো চোখা দেখায়।
কপালের রং ছাই-বাদামি। ঠোঁট হলুদাভ ধূসর-কালচে। চোখের মণি কালো, মণির
চারপাশে হলুদ বৃত্ত। পা সবুজাভ-হলুদ। ঘাড় ও মাথাজুড়ে সাদা সাদা ছোপ। গলা
সাদাটে। শরীরজুড়ে লালচে ও ধূসর অসংখ্য ছিট সুবিন্যস্তভাবে ছড়ানো।
বয়স্ক
পাখির ঠোঁট কালচে, ঘাড় ও গলা লালচে-বাদামি। মাথার চূড়া-পালক কালো, ঘন
লালচে-বাদামি পিঠ। গলা-বুক-পেট জোড়া সুবিন্যস্ত খাড়া খাড়া কালো টান, কালো
ঠোঁট, পা হলুদাভ। একনজরে বয়স্করা চকচকে জলপাই-বাদামি রঙের।
বাঘা বকের
ইংরেজি নাম Malayan night Heron/TigerBittern। বৈজ্ঞানিক নাম Gorsachius
Melanolophus। মাপ ৫১ সেন্টিমিটার। ওজন ৪১৭-৪৫০ গ্রাম। মূল খাদ্য মাছ,
কাঁকড়া ও জলজ কীটপতঙ্গ। এদের বাসার সন্ধান বাংলাদেশে একবারই পাওয়া গেছে,
খাগড়াছড়িতে। তা ছাড়া দেখা যেতে পারে সুন্দরবন ও বৃহত্তর সিলেট-চট্টগ্রামের
টিলা-পাহাড়ি বনে।
এই বকেরা বাসা করে গাছের ঘন ডালপালার ভেতর, বাসার
উপকরণও গাছের ডালপালা। ডিম পাড়ে তিন থেকে পাঁচটি। ফোটে ১৯-২৪ দিনে।
সুনামগঞ্জ অঞ্চলে এটি ডোরাবক ও পিরোজপুর-বরগুনা অঞ্চলে চোরাবক নামে স্বল্প
পরিচিত।বড়শিতে বাঘা বক
